| বঙ্গাব্দ
Space For Advertisement
ad728

উষ্ণায়নের দায় অন্যের, বোঝা গ্লোবাল সাউথের কাঁধে : ঘোষণার সময় শেষ, এখন দায়বদ্ধতার সময়

  • আপডেট টাইম: 06-10-2025 ইং
  • 199742 বার পঠিত
উষ্ণায়নের দায় অন্যের, বোঝা গ্লোবাল সাউথের কাঁধে : ঘোষণার সময় শেষ, এখন দায়বদ্ধতার সময়
ছবির ক্যাপশন: আশিস গুপ্ত

আশিস গুপ্ত  

জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর বার্ষিক বৈঠক 'কপ৩০' অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলের বেলেম শহরে, আগামী ১১ থেকে ২১ নভেম্বর। প্যারিস চুক্তির এক দশক পূর্তির এই মুহূর্তে বেলেম সম্মেলনকে অনেকে সম্ভাব্য এক মোড় ঘোরানোর জায়গা হিসেবে দেখছেন। কারণ এখন আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো বিমূর্ত পরিকল্পনার কথা নয়, বরং বাস্তব সময়ের ভয়াবহ সংকট মোকাবিলার তাগিদে রূপ নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া ইতিমধ্যেই এই সংকটের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। এ বছরই মেঘভাঙা বৃষ্টি, অকাল বর্ষণ, হঠাৎ পাহাড় ধস ও হড়পা বান ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বিপর্যস্ত করেছে। এই দুর্যোগের মূল চালিকাশক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণায়ন বৃদ্ধি—যার জন্য এই দেশগুলির দায় প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও ‘গ্লোবাল সাউথ’ প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে তীব্র ধাক্কা সামলাচ্ছে, সামান্য সম্পদ ও সীমিত অবকাঠামো নিয়ে।

কপ সম্মেলনের ইতিহাস প্রায় তিন দশক দীর্ঘ। প্রতি বছর বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিক, বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা একত্রিত হন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নির্ধারণের জন্য। তারা নিঃসরণ কমানো, অভিযোজনের কৌশল, আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও চুক্তির ঘোষণা দেন। কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিশ্রুতিগুলির বাস্তবায়ন ধীরগতি ও অসম। ২০০৯ সালে উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ২০২০ সালের মধ্যে তারা প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করবে উন্নয়নশীল দেশগুলির জলবায়ু অভিযোজন ও নিঃসরণ কমানোর কাজে সহায়তার জন্য। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি আজও পূর্ণ হয়নি। কপ৩০-এর আলোচনায় তাই গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর অন্যতম প্রধান দাবি হবে এই আর্থিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন, বৃহত্তর আর্থিক লক্ষ্যের নির্ধারণ। ২০৩০ সালের পরবর্তী সময়ের জন্য যে নতুন অর্থায়ন কাঠামো নির্ধারণ করা হবে, সেটিকে বলা হচ্ছে “নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য” বা এনসিকিউজি । এই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তীব্র দরকষাকষির সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ জলবায়ু অভিযোজন ও ক্ষতি মোকাবিলার জন্য এখন যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লোবাল সাউথের দাবি থাকবে এই অর্থ যেন সহজলভ্য হয়, জটিল শর্তে বাঁধা না পড়ে এবং ঋণ নয়, বরং অনুদানের মাধ্যমে দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে কপ৩০-তে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে ‘ক্ষতি এবং ক্ষয় তহবিল’। ২০২২ সালের কপ ২৭-এ এই তহবিল গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, এখনো পর্যন্ত এতে পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থানের কোনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। কে কত টাকা দেবে, কোন দেশ কীভাবে এই তহবিল থেকে সাহায্য পাবে, এর ব্যবস্থাপনা কার হাতে থাকবে—এই সব মৌলিক প্রশ্নের এখনও পরিষ্কার উত্তর নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলের জন্য এই তহবিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে হিমালয়ের হিমবাহ গলন, উপকূলীয় ভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো জলবায়ু বিপর্যয় ইতিমধ্যেই মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। এই ক্ষয়ক্ষতির দায় তাদের নয়, তবুও তার বোঝা বহন করছে তারাই।

এবারের কপ বৈঠকে আরেকটি কেন্দ্রীয় বিতর্ক হবে জ্বালানি নিয়ে। ২০২৩ সালের কপ২৮-এ প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত ঘোষণায় ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, যদিও ভাষাটি ছিল তুলনামূলক নরম—‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে আসা’। কপ৩০-তে এই বিতর্ক আরও গভীর হবে, বিশেষ করে ‘পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়া’ অর্থাৎ ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া বনাম ‘পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা’ বা ধীরে কমানোর মধ্যে। উন্নত দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুলনামূলক দ্রুতগতির রূপান্তরের পক্ষে থাকলেও, তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারী দেশগুলো এবং ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো বৃহৎ উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলি ধীর গতি ও নমনীয় রূপান্তরের পক্ষে থাকবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এটি এক জটিল বাস্তবতা। একদিকে জলবায়ু বিপর্যয়ের ধাক্কায় তারা বিপর্যস্ত, অন্যদিকে কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উপর তাদের নির্ভরতা এখনও গভীর। এই দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে থেকে তাদের অবস্থান নির্ধারণ সহজ হবে না।

পাশাপাশি, অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল নিয়ে বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা হবে। এখন আর জলবায়ু নীতি কেবল নিঃসরণ কমানোর মধ্যে সীমিত নেই, বরং বাস্তব অভিযোজন কৌশলকে কেন্দ্র করেই অনেক দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি, জল, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতের ক্ষেত্রে অভিযোজন এখন জরুরি বাস্তবতা। এই আলোচনায় স্থানীয় সম্প্রদায় ও প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা ও ভূমিকা স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও সামনে আসবে।

সবশেষে,কপ৩০-এ গ্লোবাল সাউথের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান একটি নির্ণায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিগত কপ বৈঠকগুলিতে অনেক সময় গ্লোবাল সাউথের দাবি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে, ফলে তাদের কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়েছে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আঞ্চলিক দাবিগুলি উত্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু ন্যায়ের প্রশ্নে—যারা ঐতিহাসিকভাবে এই সংকট সৃষ্টি করেছে, তাদের দায় স্বীকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে যথাযথ সহায়তা দেওয়ার দাবিতে—একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত অবস্থান কপ৩০-এর গতিপথ বদলে দিতে পারে। বেলেমের এই বৈঠক যদি কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানো গ্লোবাল সাউথের জন্য ভবিষ্যৎ হবে আরও দুর্বিষহ। কিন্তু যদি সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট আর্থিক প্রতিশ্রুতি এবং অভিযোজন ও ন্যায়ের প্রশ্নে বাস্তব অগ্রগতি হয়, তবে কপ৩০ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর জন্য এটি কেবল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন নয়, বরং ভবিষ্যৎ বাঁচানোর লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।

লেখক : সভাপতি , সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সাকজেএফ)।

রিপোর্টার্স২৪/সোহাগ

ad728

নিউজটি শেয়ার করুন

ad728
© সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ রিপোর্টার্স২৪ -সংবাদ রাতদিন সাতদিন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ
সকল কারিগরী সহযোগিতায় ক্রিয়েটিভ জোন ২৪