| বঙ্গাব্দ
Space For Advertisement
ad728

ফিলিস্তিনে নারী-শিশুর কান্না কি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না?

  • আপডেট টাইম: 06-10-2025 ইং
  • 201157 বার পঠিত
ফিলিস্তিনে নারী-শিশুর কান্না কি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না?

মিতা রহমান

আজ ফিলিস্তিনে শিশুর কান্না থেমে যাচ্ছে ! কারণ তাদের গলা আটকে আছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা,বোমা, ধ্বংস আর অবরোধে। এই কান্না শুধু একটি জাতির নয়—এই কান্না বিশ্ব বিবেকের! 

আজ ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তুূপের নিচে চাপা পড়ে আছে শত শত শিশুর স্বপ্ন, মা-বাবার কোলে লেপ্টে থাকা অবুঝ মুখ, স্কুল ব্যাগে ভরা অসমাপ্ত লেখাপড়া। প্রতিটি বোমার শব্দ মানে শুধু একটি ভবন ধ্বংস নয় বরং একটি শিশুর শৈশব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া। 

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতের খবর শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি এবং ক্রমান্বয়ে বয়স্ক হয়ে যাচ্ছি। সংঘাত চলে, আবার কিছু সময় থামে এবং আবার শুরু হয় সংঘাত। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে। নারী, শিশু কেউ বাদ পড়ছে না সন্ত্রাসবাদী ইসরাইলের সেনাবাহিনীর গুলি থেকে। কিন্তু, এসব দেখেও যেন বিশ্ব বিবেক বোবা হয়ে আছে। ইসরায়েল ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে চলেছে এবং কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের লোকজনকে একটি তাঁবুর মধ্যে বসবাস করার পরিবেশ তৈরি করছে। 

সম্প্রতি বিবিসির একটি ভিডিও ডকুমেন্টরিতে ফিলিস্তিনের গাজার এক পরিবারের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।  পরিবারের দম্পতির এক কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছে। বয়স তিন বছর হবে। দীর্ঘ ১২ বছর পর একমাত্র কন্যা-সন্তানের জন্মের কারণে যুদ্ধবিধ্বস্থ পরিবারের মাঝেও অনেক আনন্দ বয়ে গিয়েছিল। বাবা পেশায় একজন স্থানীয় ফটোগ্রাফার। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ছবি তোলার কাজ করছিলেন। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে খবর পেলেন পরিবারের সবার সঙ্গে একমাত্র কন্যাসন্তানও ইসলাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, "ইসরায়েল শুধু হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে নাই, ফিলিস্তিন জনগণের সঙ্গেও যুদ্ধ করছে। হত্যা করছে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের।

দখলদার ইসরাইলের দখলদারিত্বের কারণে ফিলিস্তিনে লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশু অনাহারে, পিপাসায়, চিকিৎসা ও ঔষধের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তাঁদের জীবন আজ শোষণ ও নিষ্ঠুরতার শিকার। দুনিয়ার অন্য যেকোনো মানুষের মতো, তাদেরও অধিকার ছিল শান্তিতে বেঁচে থাকার কিন্তু তাদের সঙ্গী হয়েছে নিপীড়ন, হত্যা আর ধ্বংস। বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, ইসরায়েল আজ পাষণ্ডদের হাতে বন্দী, ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের মাতৃভূমিতে নিজেদেরই গৃহহীন, নির্যাতিত। পবিত্র মসজিদ আল-আকসা, যেখানে বিশ্বের সকল নবী রসুল এবং আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সা.) নামাজ আদায় করেছেন, আজ সেখানে ইহুদিরা নিজেদের স্বার্থে আগ্রাসন চালাচ্ছে। পদদলিত করছে মানবাধিকার আর মানবতাকে। তাদের কষ্টের মাত্রা এতটাই বেশি, যে কথায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। নারী ও শিশুদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, চিকিৎসার অভাব, খাদ্য সংকট, এমনকি পানির জন্যও তাদের সংগ্রাম—এ সকল অমানবিকতার চিত্র  দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী ধ্বংসের চিত্র আঁকা হয়ে গেলেও, ফিলিস্তিনের মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, আরব বিশ্ব বা বিশ্ব-মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে। 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে আরও অনেক বেশি। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত স্থাপনাও ইসরাইলি বোমাবর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হামলাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সম্ভাব্য ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিশ্বশক্তিগুলোর নীরবতা ও দ্বিমুখী নীতির কারণে ইসরাইল নির্ভয়ে নির্বিচারে চালিয়ে যাচ্ছে তার অভিযান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা অনেক দেশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে আসছে, যা আজ আন্তর্জাতিক ন্যায় ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি। 

সারা রাতদিন ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজা ভূখণ্ডের অধিবাসী নারী শিশুরা মৃত্যু ভয়ে নিদ্রাহীন হয়ে জেগে থাকে প্রায় সকলেই। মাথার উপর দিয়ে ইজরাইলের যুদ্ধ বিমানগুলো মার মার হুহু শাঁ শাঁ শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে।ছোট্ট ছোট্ট শিশু  সব ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তাদের মাকে শক্ত করে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। যেটুকু অবশিষ্ট অক্ষত আছে মাথা গুঁজার মতো জায়গা- সেখানে তাদের মায়েরা ঠাঁই নিয়ে শিশুদের বাচাঁতে লড়্ই করে চলেছে। মায়েরা তাদের কোলের দুধের শিশুদের নিজের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখছে। 

ইসরাইেলের বর্বোরিত গণহত্যার বিষয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা জটিল। আন্তর্জাতিক মূলধারার অনেক গণমাধ্যম একপেশেভাবে শুধু ইসরাইলি বয়ান প্রচার করছে। হামাসের নাম সামনে এনে পুরো গাজাবাসীকে দায়ী করার এই কৌশল মূলত বাস্তব চিত্রকে আড়াল করারই অপচেষ্টা মাত্র। অথচ, বাস্তবতা হলো—ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিরীহ নাগরিক, স্কুলগামী শিশু, চিকিৎসাধীন রোগী, ঘরে ঘুমিয়ে থাকা পরিবার। বিশ্ব শান্তির প্রধান বাধা ইসরাইলি রাষ্ট্র সবসময় নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এই ধরনের হামলার বৈধতা দেখাতে চায়। কিন্তু, বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন — কোনো রাষ্ট্র কি আত্মরক্ষার নামে এক গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালাতে পারে ?

ফিলিস্তনের এই সংকট কেবল ফিলিস্তিনের নয়, এই সংকট পুরো বিশ্ব মানবতার সংকট। যদি গাজার কান্না আমাদের না কাঁদায়, বিশ্ব বিবেককে নাড়া না দেয়, তাহলে আগামী দিনে অন্য কোথাও ঘটবে এমন বর্বরতা, আর তখন আমরা নিজেরাই হয়ত নির্যাতিত হবো, নিজেদের কান্নার জন্য সময় পাবো না। ইতিহাস সাক্ষী, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারলে নিপীড়ন একসময় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনের গাজার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুলের দেয়ালে লেখা ছিল, “আমরা বাঁচতে চাই, শুধু মানুষ হয়ে।” এই কথাটি কেবল এক শিশুর মুখে কথা নয়, শুধু দেয়াল লেখন নয়, শুধু আকুতি নয়, বরং তা হলো গোটা মানবজাতির বিবেকের পরীক্ষা। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের—আমরা সেই আহ্বানে সাড়া দেব, না নীরব থেকে বর্বরতার পৃষ্ঠপোষক হব? 

আজকের এই পৃথিবীতে, যারা ইসরাইলী ইহুদি পাষণ্ডদের হাতে হাত মিলিয়ে ফিলিস্তিনের মানুষদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীকে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে মানবিক বিবেক ও ন্যায়বিচারের পক্ষে প্রত্যেকটি মানুষকে সোচ্চার হওয়া অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকে গলা উঁচু করে বলতে হবে, “ফিলিস্তিনের শিশুরা, মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে, পৃথিবীতে আসতে পারেনি নিরাপত্তায়, তারা জন্মগতভাবেই নিপীড়িত।”

হয়তো ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের এ অন্যায় যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। বিশ্বের দরবারে ফিলিস্তিনবাসীও পূর্ণ স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাবে। লাখো মা-বাবা হারা শিশুরা যদি বেঁচে থাকে, তারাও একদিন সবাই বড় হবে। তারা সেদিন জানতে পারবে তাদের মাতৃভূমি পবিত্র ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের ‘মসজিদুল আকসা’কে কেন্দ্র করে ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠী তাদের মা-বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যুদ্ধের নামে সম্পূর্ণ অন্যায় ভাবে চালিয়েছিলো এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আর বিশ্বের জাতিসংঘ, বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো, মুসলিম বিশ্ব যারা মুখে মানবতার কথা বলে তারা নির্বাক হয়ে শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলো সেদিন। ঘৃণায় তারা তাকাবে বিশ্বের দিকে। ধিক্কার দিবে তাদেরকে। যারা মানবতার কথা বলে অমানবিকতার কাজের সহায়তা করেছছে। 

"ফিলিস্তিনের নারী-শিশুর কান্না আমাদের বিবেক নাড়া দিক। আসুন বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হই, লড়াই করি। সুউচ্চকণ্ঠে বলতে হবে, এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। 

( লেখক : আহ্বায়ক, জাতীয় নারী আন্দোলন ও যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাপ)


 রিপোর্টার্স২৪/এসসি

ad728

নিউজটি শেয়ার করুন

ad728
© সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ রিপোর্টার্স২৪ -সংবাদ রাতদিন সাতদিন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ
সকল কারিগরী সহযোগিতায় ক্রিয়েটিভ জোন ২৪