শাহানুজ্জামান টিটু
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ইঙ্গিত। কিন্তু এর সঙ্গে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে মার্জিত রাজনৈতিক ভাষা ও শালীনতার জায়গা ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, যত তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা যায়, ততই আলোচনায় থাকা যায়। অথচ ইতিহাস বলে, লাগামহীন ভাষা কখনোই নেতৃত্বের প্রতীক নয়, বরং তা নিজের ও দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।
বক্তব্যে সংযম, রাজনীতিতে পরিণতি
রাজনীতিতে মন্তব্য করা মানেই দায়িত্ব নেওয়া। কিছু সময় নিজের অবস্থান ও ভূমিকা বুঝে কথা বলতে হয়। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির মঞ্চে এমন কিছু তরুণের দেখা মেলে, যাদের বক্তব্যে সংযমের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা যেন “বেয়াদবির প্রতিযোগিতায়” নেমেছে। মনে হয়, আক্রমণাত্মক শব্দেই জনপ্রিয়তা আসবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী বেয়াদবি দিয়ে কেউ বড় নেতা হতে পারেনি।
রাজনীতিতে সম্মান ও আস্থার জায়গা গড়ে ওঠে মেধা, ভদ্রতা ও মার্জিত বাচনভঙ্গির মাধ্যমে। যে তরুণ নেতা নিজের বক্তব্যে বারবার ব্যক্তিগত আক্রমণ, বিদ্রূপ ও কটূক্তির আশ্রয় নেয়, সে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করে। জনগণ এমন রাজনীতি চায় না; তারা চায় দায়িত্বশীল নেতৃত্ব।
ব্যাঙ ও হাতির রাজনীতি
রাজনীতির মঞ্চে কখনো কখনো কিছু নেতা এমন আচরণ করেন, যেন তারা দেশের প্রধান সিদ্ধান্তনির্মাতা। অথচ বাস্তবে তারা রাজনৈতিকভাবে শিশুর পর্যায়ে। এদের অবস্থা ঠিক ব্যাঙ ও হাতির গল্পের মতো। ব্যাঙ ভাবলো সে হাতির সমান গর্জন করতে পারবে, কিন্তু ফুলে ফেঁপে শেষ পর্যন্ত নিজেই ফেটে গেল।
এক বছর বয়সী রাজনৈতিক দল যদি মনে করে ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই এখনই ক্ষমতায় পৌঁছে যাবে, তবে সেটি নিছক আত্মভ্রম। ভাই, নিজের বক্তব্য রাতে ঘুমানোর আগে একবার মনোযোগ দিয়ে শোনো তখন বুঝতে পারবে জনগণ তোমার পাশে আছে, নাকি হাসছে।
ইতিহাসের শিক্ষা: ফ্যাসিবাদ টিকে না
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যারা লাগামছাড়া বক্তব্য ও ক্ষমতার দাম্ভিকতায় এক সময় ফ্যাসিস্ট আচরণে জড়িয়ে পড়েছিল। আজ তারা কেউ দেশে নেই, কেউ রাজনীতি থেকে নির্বাসিত। এক সময় যাদের জন্য হাততালি পড়তো, তারাই আজ দলবিহীন ও সমর্থনহীন।
ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি নিজের বাচনভঙ্গি ফ্যাসিস্টদের মতো হয়, তবে সেই রাজনীতি টেকসই হয় না। যারা এখন চটকদার মন্তব্যে বাহবা দিচ্ছে, কাল তারাই “বহিষ্কার করো” স্লোগান তুলবে- এ ইতিহাস নতুন নয়।
তরুণদের দায়িত্বশীল রাজনীতি প্রয়োজন
অল্প বয়সে রাজনীতিতে আসা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তরুণদের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত করে। কিন্তু তরুণ মানেই যে জ্ঞানী বা পণ্ডিত, তা নয়। সময়ের সঙ্গে দায়িত্ব, ধৈর্য ও শালীনতা অর্জন করতে হয়।
তরুণ নেতৃত্বের উচিত-মার্জিত ভাষায় বক্তব্য রাখা, প্রতিপক্ষকে অসম্মান না করে যুক্তিতে পরাজিত করা। জনগণ সেই নেতাকেই শ্রদ্ধা করে, যিনি সমালোচনা করেন শালীনভাবে এবং বিকল্প পথ দেখান যুক্তির মাধ্যমে।
সংগঠন মজবুত করা
রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে চাইলে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হয়। এখন ফেসবুক পোস্ট বা টকশোতে জনপ্রিয় হওয়ার সময় নয়; এখন মাঠে গিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের সময়।
নতুন দলের জন্য প্রথম কাজ হওয়া উচিত সাংগঠনিক কাঠামো দৃঢ় করা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক ভিশন জনগণের সামনে তুলে ধরা। নির্বাচনে জামানত বাঁচাতে হলেও ভোটারদের দরজায় যেতে হয়। বক্তৃতার আগুন দিয়ে নয়, কাজের উদাহরণ দিয়েই জনগণের হৃদয়ে জায়গা পাওয়া যায়।
বড় মুখে বড় কথা নয়, বড় মন চাই
বাংলাদেশের রাজনীতি বহু উত্থান-পতন দেখেছে। এখানে অনেক ক্ষমতাধর পণ্ডিতদের উত্থান যেমন হয়েছে, তেমনি পতনও ঘটেছে। ইতিহাসের এই বাস্তবতা তরুণদের মনে রাখা দরকার।
ক্ষমতায় থাকা মানে সর্বজ্ঞানী হওয়া নয়। বড় মুখে বড় কথা না বলে, বড় মন নিয়ে কাজ করতে হয়। জনগণ এমন নেতাকেই বিশ্বাস করে, যিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং শত্রুকেও সম্মান দেন।
দায়িত্বশীল রাজনীতি: দেশের জন্য আশার প্রতীক
আজকের তরুণ নেতৃত্ব আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ধারণ করবে। তাই তাদের বাচনভঙ্গি, আচরণ ও রাজনৈতিক দর্শন হতে হবে অনুকরণীয়। তরুণদের মুখে যেন ঘৃণা নয়, আশার বাণী শোনা যায়।
রাজনীতি মানে প্রতিপক্ষ ধ্বংস নয় মানুষের আস্থা অর্জন। জনগণই রাজনীতির চূড়ান্ত বিচারক। তারা ভাষার মার্জিততা, যুক্তির শুদ্ধতা ও কাজের ধারাবাহিকতাকেই মূল্যায়ন করে।
ওজন বুঝে ভোজন করো
বড় বড় কথা বলা সহজ, কিন্তু দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। তাই বলবো-ওজন বুঝে ভোজন করা ভালো। এখনই নিজেকে “পণ্ডিত” মনে করো না। সময়ই বলবে, কে নেতা এবং কে রাজনৈতিক পর্যটক।
রাজনীতিতে স্থায়ী হতে হলে জনগণের পাশে থাকতে হবে, ফেসবুকের জনপ্রিয়তায় নয়-মানুষের আস্থায় জায়গা করে নিতে হবে। তরুণদের জন্য সেটাই হোক সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
তথ্যসূত্র ও বিশ্লেষণমূলক পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশ রাজনৈতিক গবেষণা কেন্দ্রের (BPRC) জরিপ অনুযায়ী (২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর), ৬২% ভোটার তরুণ নেতাদের প্রতি আস্থা রাখে যদি তারা “মার্জিত ও দায়িত্বশীল ভাষায়” কথা বলেন।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (BIGD)-এর রিপোর্ট (২০২4)-এ বলা হয়, “তরুণদের ভাষাগত সংযম ও নৈতিক নেতৃত্বই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে জনগণের আস্থা ফেরাতে পারে।” ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারী ভাষা যতই জনপ্রিয় হোক, দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট