| বঙ্গাব্দ
Space For Advertisement
ad728

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন:

বিএনপির অবস্থান - সংস্কার ও গণভোটের পক্ষে, প্রহসনের বিরুদ্ধে

  • আপডেট টাইম: 01-11-2025 ইং
  • 49050 বার পঠিত
বিএনপির অবস্থান - সংস্কার ও গণভোটের পক্ষে, প্রহসনের বিরুদ্ধে
ছবির ক্যাপশন: গ্রাফিক্স: রিপোর্টার্স২৪

ড. এম মুজিবুর রহমান:

বাংলাদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য থেকে জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে বিএনপি বরাবরই সমর্থন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও প্রস্তাবনাগুলো দেখে স্পষ্ট হচ্ছে—সংস্কারের নামে কিছু পক্ষ পরিকল্পিতভাবে জাতীয় ঐক্যের ভিত দুর্বল করতে চাইছে।

বিএনপি কি সংস্কারের পক্ষে ? উত্তর – হ্যাঁ। 

বিএনপি কি গণভোটের পক্ষে ? উত্তর – হ্যাঁ। 

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিএনপি ও দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে সংস্কারের বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা এসেছিল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থেকে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মূল কাজ ছিল ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে কাজ করা, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া নয়। প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন—“যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ ঐক্যমত্যে পৌঁছাবে, কেবল সেসব বিষয়েই সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।” এমনকি তিনি “কম সংস্কার” ও “বেশি সংস্কার” —এই দুটি আউটলাইন দিয়েছিলেন যাতে নির্বাচন ও সংস্কার সমান্তরালভাবে এগোয়।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, দুই-তিনটি রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রক্সি সমর্থকরা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির অজুহাতে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তারা সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরির ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপির মতে, এই প্রচেষ্টা মূলত একটি পরিকল্পিত ক্যাম্পেইন, যার লক্ষ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহত করা।


নোট অব ডিসেন্টকৃত ইস্যু যোগ করে বিতর্কিত গণভোটের আয়োজন :

বিএনপি স্পষ্টভাবে বলছে, তারা সংস্কার ও গণভোট—দু’টিরই পক্ষে। তবে যেভাবে ৪৮টি সাংবিধানিক বিষয়ের ওপর একযোগে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ গণভোটের প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেটি রাজনৈতিক ঐক্য ও বাস্তবতার পরিপন্থী। বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দলসমূহ যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে তা গণভোটের অংশ করে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে হুমকির মূখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এরা মূলত সংস্কারকে বাস্তবায়নের জন্য নয় বরং সংস্কারের নামে বিএনপির বিরুদ্ধে একটা প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন করে আগামী নির্বাচনকে প্রলম্বিত করতে চাচ্ছেন আবব্জি নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন। বিএনপি মনে করে, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে গণভোট আয়োজনই যৌক্তিক—কারণ এতে ব্যয় সাশ্রয় হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।

কিন্তু বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী আলাদা করে গণভোট আয়োজন মানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, যা নির্বাচনের পথে বড় বাধা তৈরি করবে। 


জুলাই সনদের বৈধতা ও সংবিধানিক অসঙ্গতি :

বাংলাদেশের সংবিধান এখনো বলবৎ আছে; তা স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি। বরং ‘ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি’র আওতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালিত হচ্ছে—যা গণঅভ্যুত্থানের নৈতিক সমর্থনের মাধ্যমেই বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু এখন যে “লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার” বা “কনস্টিটিউশনাল অর্ডার”-এর কথা বলা হচ্ছে, তা ইতিহাসগতভাবে কেবল সামরিক বা কোয়াসি-সামরিক শাসনের সময় প্রযোজ্য ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।


ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ :

বিএনপি অভিযোগ করেছে, তারা যেই খসড়ায় স্বাক্ষর করেছে, চূড়ান্ত দলিল তার সঙ্গে মেলে না। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন:

“বিএনপি বলছে তারা যেটাতে স্বাক্ষর করেছে, আর চূড়ান্ত যে দলিল হয়েছে তার মধ্যে ফারাক আছে। এটা তো গুরুতর অভিযোগ। একটা কাগজের কথা বলে সাইন করিয়ে নিলেন, আর অন্য কাগজ ফাইনালাইজ করলেন—এটা হয় না। বিএনপির এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ভীষণভাবে নষ্ট হয়েছে।” (সূত্র: কালের কণ্ঠ, ৩০ অক্টোবর ২০২৫)

তিনি আরও বলেন—“জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগই বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব থাকলে, এককক্ষবিশিষ্ট বর্তমান সংবিধান কার্যকর থাকবে কিভাবে? সংবিধান বাতিল না করে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো কার্যকর করা অবাস্তব।”

ড. মালিক আরও সতর্ক করেছেন, “৪৮টি বিষয়ের ওপর একযোগে গণভোট আয়োজন করা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকেও অনুচিত। গণভোট সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে হয়—যেমন ব্রিটেনে ব্রেক্সিট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভোটের আইনি কাঠামোই এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টায় দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা আরও জটিলতায় পড়বে।”


সংস্কারের নামে বিভাজন নয়, ঐক্যের পথে অগ্রগতি চাই :

বিএনপি মনে করে, দেশের জনগণ পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেই পরিবর্তন হতে হবে ঐক্য ও বৈধতার ভিত্তিতে, কোনো পক্ষের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যমে নয়।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নামে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হয় বা সংবিধানের বাইরে গিয়ে আইনগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সংস্কারের নামে অনৈক্য নয়—বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিসমূহের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশকে পরবর্তী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। বিএনপি সংস্কারের পক্ষে, গণভোটের পক্ষে—তবে সবকিছু হতে হবে সংবিধানের সীমারেখার মধ্যে, জনগণের অংশগ্রহণে, এবং সর্বোপরি—দেশের স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ণ রেখে।


লেখক: সংবাদ বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।  যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত), যুক্তরাজ্য বিএনপি। সাবেক সহকারি অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

ad728

নিউজটি শেয়ার করুন

ad728
© সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ রিপোর্টার্স২৪ -সংবাদ রাতদিন সাতদিন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ
সকল কারিগরী সহযোগিতায় ক্রিয়েটিভ জোন ২৪